ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান
সাম্প্রদায়িকতা বাংলার হিন্দু-মুসলমান বিরোধের ফসল। ব্রিটিশ রাজের নাগপাশ থেকে উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই বিষয়টি এমন সব ঘটনাবলির ফল, যেগুলিকে অনেক সময়ই স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে স্ববিরোধী বলে মনে হয়। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী হয়ে ওঠার সাথে সাথে সাম্প্রদায়িকতা আত্মপ্রকাশ করে। এর ফলে উপমহাদেশ ধর্মভিত্তিক দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রকটভাবে ধরা পড়ে। মুসলিম রাজনীতিবিদগণ বঙ্গীয় আইন সভায় ও অন্যত্র বিপুল মুসলমান প্রজার পক্ষে এবং জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলেন। জমিদারদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু। ১৯২৮ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের উপর আলোচনাকালে এমনটিই প্রতিভাত হয়। আইন সভার মুসলমান সদস্যগণ এ আইনের যে সকল ধারা বর্গাদার, ক্ষুদ্রচাষি ও প্রজার অনুকূলে ছিল সেগুলির পক্ষে ভোট দেন। অপর পক্ষে স্বরাজী ও অস্বরাজী নির্বিশেষে সকল হিন্দু সদস্য জমিদারদের স্বার্থ সংরক্ষণের পক্ষে অর্থাৎ প্রজার বিপক্ষে ভোট দেন। সাধারণ মুসলমানদের দৃষ্টিতে স্বভাবতই আইন সভার হিন্দু সদস্যগণকে জমিদারদের স্বার্থ সংরক্ষণে অতিশয় উদগ্রীব বলে প্রতীয়মান হয়।
ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িকতা স্বভাবতই সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কারণ ও প্রকৃতি নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে বিতর্কের অবতারনাও হয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণা হিন্দু প্রাধান্য এবং মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে একটা যোগসূত্র স্থাপনের বিশেষ চেষ্টা করে যাচ্ছে।বিশ শতকের প্রথমার্ধে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাসমূহের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এই অর্থনৈতিক বিভাজন।
খিলাফত আন্দোলন ছিল সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে আর একটা মাইল ফলক। ধর্মীয় বিষয়ে আন্দোলন শুরুর আগে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ঘটানো হয়েছিল, আর এই আন্দোলন ভেঙ্গে গেলে একটা প্রচন্ড সাম্প্রদায়িক রোষের সৃষ্টি হয়। এই আন্দোলন উলেমাগণকে একটা রাজনৈতিক মঞ্চ তৈরি করে দেয় এবং তাঁরা তাঁদের স্বধর্মীদের মনে একটা সচেতনতা ও একটা প্রত্যয় সৃষ্টি করেন, যা ভবিষ্যতে তাদেরকে দ্বিজাতিতত্ত্ব গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। অপর দিকে মদনমোহন মালব্যের মতো হিন্দু নেতাগণ ‘হিন্দ-হিন্দি-হিন্দু’ জিগির তোলেন।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রকটভাবে ধরা পড়ে। মুসলিম রাজনীতিবিদগণ বঙ্গীয় আইন সভায় ও অন্যত্র বিপুল মুসলমান প্রজার পক্ষে এবং জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলেন। জমিদারদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু। ১৯২৮ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের উপর আলোচনাকালে এমনটিই প্রতিভাত হয়। আইন সভার মুসলমান সদস্যগণ এ আইনের যে সকল ধারা বর্গাদার, ক্ষুদ্রচাষি ও প্রজার অনুকূলে ছিল সেগুলির পক্ষে ভোট দেন। অপর পক্ষে স্বরাজী ও অস্বরাজী নির্বিশেষে সকল হিন্দু সদস্য জমিদারদের স্বার্থ সংরক্ষণের পক্ষে অর্থাৎ প্রজার বিপক্ষে ভোট দেন। সাধারণ মুসলমানদের দৃষ্টিতে স্বভাবতই আইন সভার হিন্দু সদস্যগণকে জমিদারদের স্বার্থ সংরক্ষণে অতিশয় উদগ্রীব বলে প্রতীয়মান হয়।
কংগ্রেস ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনকে ভারতের স্বাধীনতা দাবির প্রতি নতুন হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে এবং এতে কংগ্রেস ও ব্রিটিশ রাজের মধ্যেকার তিক্ততা বৃদ্ধি পায়। কংগ্রেস-মুসলিম লীগ অনৈক্যকে পুঁজি করে ভারত সরকার এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করে যাতে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে জোরদার করতে না পারে। সংগত কারণেই ১৯৩৬ পরবর্তী বাংলায় সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে ইউরোপীয়গণ মুসলিম লীগের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের প্রতি সমর্থন জুগিয়ে চলে। এসব কিছুই ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে জোরদার করে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপান্তর ঘটার মধ্যে। ১৯৪০ পূর্ববর্তী দাঙ্গাগুলি যেখানে ছিল শ্রেণিভিত্তিক এবং মোটামুটি সংগঠিত রাজনীতিমুক্ত, সেখানে ১৯৪০ পরবর্তী দাঙ্গাগুলি ছিল সুস্পষ্টভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত।
১৯৪৬ সালের ভয়াবহ কলকাতা হত্যাকান্ড এবং নোয়াখালী-ত্রিপুরার চরম নিষ্ঠুরতা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এতদসত্ত্বেও ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট হিন্দু-মুসলমানগণ সম্মিলিতভাবে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তিতে আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ পায়।
Comments
Post a Comment